‘তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে অ্যাসেম্বলি’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] সৈয়দ বদরুল আহসান

‘তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে অ্যাসেম্বলি’ – বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের এই অংশটি বিশ্লেষন করেছেন সৈয়দ বদরুল আহসান।

ভুট্টো তার সমর্থক এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে এই বলে সতর্ক করে দেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা এখন খুনি মেজাজে রয়েছে এবং তারা অবাঙালি রাজনীতিবিদদের হত্যা করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে ।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

একাত্তরের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ [ ৭ই মার্চের ভাষণ] দেন তা বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের জাতিগত বঞ্চনার শিকার বাঙালি জাতির মুক্তির পথনির্দেশ ছিল এই ভাষণে। ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু দেশবাসী এবং বিশ্বের কাছে অজানা এক ইতিহাস উপস্থাপন করেন।

বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রাম ও সুযোগ্য নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা যে মহীরূহ আকার ধারণ করেছে, লাখ লাখ মানুষে ঠাসা বিশাল জনসমুদ্র তার উজ্জ্বল স্বাক্ষর বহন করে। ভাষণে অপরিহার্যভাবে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পৌছার সুনির্দিষ্ট দিক- নির্দেশনা গুরুত্ব পায়। গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে আদর্শ প্রতিষ্ঠায় এ দেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে লড়াই-সংগ্রাম করে আসছিল এ দিনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু তা আরও সুস্পষ্ট করেন। এবং এটাই ছিল জনগণের প্রত্যাশা।

বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে তাঁর অনন্য বাগ্মিতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার আলোকে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বাঙালি জাতির আবেগ, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষাকে এক সুতোয় গাঁথেন ।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

জুলফিকার আলী ভুট্টোকে খুশি করতে সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ষড়যন্ত্রের যে নীল নকশা তৈরি করছিল এই ভাষণে তার কঠোর সমালোচনার পাশাপাশি জাতির ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু । ৭ই মার্চের ভাষণে তাঁর শব্দ ছিল সুস্পষ্ট এবং চলমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কেন বাঙালির স্বাধিকার প্রয়োজন, ৭ই মার্চের ভাষণে তিনি তা ব্যাখ্যা করেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যরা উদ্বোধনী অধিবেশনে যোগ দিতে ঢাকায় এলে পরিষদ কসাইখানায় পরিণত হবে বলে ভুট্টো চরম উস্কানিমূলক যে বিবৃতি প্রকাশ করেন, সে সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন এবং আওয়ামী লীগ ও বাংলার জনগণের হাতে পাকিস্তানের শাসনভার তুলে না দেওয়ার জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে যে গভীর চক্রান্ত চালানো হচ্ছে তার বর্ণনা দেন ভুট্টোর বিবৃতিটির সারবত্তা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতির নামান্তর।

এটি ছিল সামন্তবাদী চেতনা ও বৈষম্যমূলক মনোভাবের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। বিবৃতিটির উদ্দেশ্য ছিল দেশের পশ্চিমাঞ্চল থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যদের ভয় দেখিয়ে পরিষদে যোগদান থেকে বিরত রাখা। বিবৃতিতে বাঙালিদের মারমুখী জনতা হিসেবে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস চালানো হয়। সেখানে বলা হয়, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্যদের শারীরিকভাবে আঘাত করার জন্য বাঙালিরা উদগ্রীব হয়ে আছে। ভুট্টো তার সমর্থক এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে এই বলে সতর্ক করে দেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা এখন খুনি মেজাজে রয়েছে এবং তারা অবাঙালি রাজনীতিবিদদের হত্যা করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে ।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত নিখুঁতভাবে ভুট্টোর জঘন্য বিবৃতির প্রকৃত উদ্দেশ্য তুলে ধরেন এবং বাঙালি ও পশ্চিম পাকিস্তানিসহ সারা বিশ্বের মানুষকে অবহিত করেন যে, এ দেশে একটি রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টির জন্য গভীর ষড়যন্ত্র চলছে । তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে স্পষ্ট করেন- ভুট্টোর বিবৃতিটি ওই ষড়যন্ত্রেরই অংশ।

‘তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে অ্যাসেম্বলি’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] সৈয়দ বদরুল আহসান

প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কয়েকটি বিষয় উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। সেগুলো হলো

প্রথমত, ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি ও ইয়াহিয়া জান্তা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, যাতে জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে না পারে।

দ্বিতীয়ত, রাওয়ালপিন্ডির সামরিক-বেসামরিক আমলা চক্র তাঁকে এবং তাঁর দলকে ৬-দফা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে পাকিস্তানকে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের সুযোগ দেবে না। তৃতীয়ত, ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসলে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে বলে ভুট্টো যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, তা পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহলের সামন্তবাদী মানসিকতার কুৎসিত বহিঃপ্রকাশ ।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

বাঙালিরা বিশ্বস্ত নয়, তাদের হাতে ক্ষমতা দেয়া যায় না, তারা রক্ত পিপাসু। এসব কথায় এটা পরিষ্কার হয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানিদের মানসিকতা হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে দাবিয়ে রাখা, তাদের ওপর শোষণ-পীড়ন চালিয়ে যাওয়া। এর প্রেক্ষাপটে তুখোড় রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধুকে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌছুতে মোটেই বেগ পেতে হয়নি । ৭ই মার্চের ভাষণে একটি মাত্র উক্তির দ্বারা তিনি তাঁর এই সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ করেন।

পশ্চিম পাকিস্তানি কুচক্রিরা তাঁকে ক্ষমতায় দেখতে প্রস্তুত আছে এমন কথা বঙ্গবন্ধু স্বপ্নেও ভাবেননি। সেই সঙ্গে পশ্চিমাদের এসব ষড়যন্ত্রের আঁচ পেতে তাঁকে একটুও বেগ পেতে হয়নি। এ কারণে তাঁর ৭ মার্চের ভাষণের প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য ছিল খুবই পরিশীলিত ও যুক্তিনির্ভর । সর্বোপরি এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন।

‘ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে’ বলে যে অভিযোগ আনা হয়, তা ছিল মূলত বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর জনগণের বিরুদ্ধে ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের এক রূপরেখা কাজেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ভবিষ্যতের জন্য তাঁকে ভিন্ন একটি পথ অনুসন্ধান করতে হবে । সেই পথের নির্দেশনা দিয়ে তিনি সেদিনের ভাষণ শেষ করেন। এই ভাষণের মধ্য দিয়েই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্ন বিকশিত হতে শুরু করে ।

[ ‘তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে অ্যাসেম্বলি’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] ]

লেখক : সৈয়দ বদরুল আহসান
সহযোগী সম্পাদক, ডেইলি অবজারভার

‘তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে অ্যাসেম্বলি’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] সৈয়দ বদরুল আহসান
‘তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে অ্যাসেম্বলি’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] সৈয়দ বদরুল আহসান

আরও পড়তে পারেন :

Leave a Comment