বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে বলেন – ‘তিনি আমার কথা রাখলেন না। তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা।’ – বঙ্গবন্ধুর ভাষনের এই অংশটি বিশ্লেষন করেছেন মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।
ভুট্টোর ‘পা কেটে দেওয়ার হুংকার’ এবং ‘রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবার হুমকি উপেক্ষা করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গণপরিষদের ৩৫ জন সদস্য ৩ মার্চ ডাকা অধিবেশনে যোগ দিতে ঢাকায় আসেন। এর মধ্য দিয়ে তারা শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বকে মেনে নিতে চেয়েছিলেন ।
জাতির পিতার ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ বা স্বাধীনতা ঘোষণাকে বিভিন্ন সময়ে নানা ভূষণে আখ্যায়িত করা হয়েছে । কিন্তু রাজনীতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই কবিতার উৎপত্তির পরিপ্রেক্ষিত এবং এর ফলে সৃষ্ট সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কথা নিয়ে তেমন গবেষণা হয়নি বললেই চলে।
কোনো নোট ছাড়া উনিশ মিনিটের স্বতঃস্ফূর্ত ৭ই মার্চের ভাষণে উল্লিখিত বাক্যটি উচ্চারণ করে বাঙালি জাতির প্রাণপুরুষ ও হৃদয়ের স্পন্দন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্রের প্রতি তাঁর অবিচল আস্থার কথা জানিয়েছেন। পাশাপাশি গণতন্ত্রসম্মত আচরণ না করার জন্য সেনাপতি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ।
৭ই মার্চের ভাষণের প্রেক্ষাপট হিসেবে এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, সত্তরের নির্বাচন সামরিক সরকারের জারি করা একটি ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক’ বা এলএফও (LFO)-এর অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। অনেকেই এখনও ভেবে হয়রান হন যে, ওয়েস্ট মিনিস্টার টাইপের সংসদীয় গণতন্ত্রে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাসী শেখ মুজিব কী কারণে একটি সামরিক ফরমানের অধীনে নির্বাচনে যেতে রাজি হলেন!
এটি যে তাঁর একাধারে নেতৃত্বের দূরদর্শিতা, পরিপক্ক আলোচনাকারীর কৌশল এবং ক্ষমতায় না গেলে বাঙালি জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের আকাঙ্ক্ষা বিফলে যাবে- এই তিন উপাদানের সমন্বয়প্রসূত উপলব্ধি তা খুব সহজে বোঝা যায় না।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার খায়েশ ছিল, তিনি নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হবেন। ইংরেজদের মতো ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পদ্ধতিতে তিনি শতকরা ছাপ্পান্ন ভাগ বাঙালির ভেতর ঝগড়া বিবাদ বাঁধিয়ে এবং তার একান্ত অনুগত বাঙালিদের একাংশকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষে টেনে আনতে পারবেন বলে মনে করতেন।
৩০০ আসনের গণপরিষদে জনসংখ্যার অনুপাতে পূর্ব পাকিস্তানের আসন ছিল ১৬৯টি। আর পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ১৩১টি আসন। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর পূর্বাভাস ছিল যে, গণপরিষদের পূর্ব পাকিস্তানি সদস্যদের একটি অংশকে শেখ মুজিব ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের বিপক্ষে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩১টি আসনের সদস্যের সঙ্গে যোগ দেওয়াতে পারলেই ‘ইয়াহিয়ার গণতান্ত্রিক মসনদ’ পোক্ত হবে এবং তিনি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট রূপে আবির্ভূত হবেন।
এই পূর্বাভাস ছিল ইয়াহিয়া খানের কাছে সুসংবাদের মতো । কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হিসাব ছিল ভিন্ন; তিনি ইয়াহিয়া খানের গণতন্ত্রী হয়ে ওঠার খায়েশের সুযোগ নেন। নির্বাচনে যাওয়ার শর্ত হিসেবে বঙ্গবন্ধু ‘ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট’-এর প্রস্তাব দেন। সামরিক শাসকও বঙ্গবন্ধুর টোপটি গিলে ফেলেন এবং আওয়ামী লীগকে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনে নামাতে সক্ষম হন।
নির্বাচনে বাংলার নয়নমণি, অবিসংবাদিত নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে এককভাবেই ১৬৭টি আসন জয় করে (বাকি দুটি আসন জেতেন নান্দাইলে জনাব নূরুল আমিন ও পার্বত্য চট্টগ্রামে রাজা ত্রিদিব রায়) নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আর প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮ আসন লাভ করে ।
নির্বাচনের ফলাফলে স্বাভাবিকভাবেই ইয়াহিয়া খানের মাথা বিগড়ে যায়। এ সময় তার নানারকম পানাহার ও আসরের সঙ্গী জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। তবে তারা ভড়কে যান এই ভেবে যে, চুক্তি অনুযায়ী দেশের দ্বিতীয় রাজধানী ঢাকায় যদি গণপরিষদের অধিবেশন ডাকা হয় তাহলে বাঙালির দাপুটেপনায় শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের দুর্জয় অঙ্গীকার বাঙালির মুক্তিসনদ ছয়দফাও পাস হবে।
ইয়াহিয়া, ভুট্টোসহ পশ্চিম পাকিস্তানকে হতে হবে পূর্ব বাংলার অধীন। শুরু হবে তেইশ বছরের শোষণ-বঞ্চনা শোধরানোর পটভূমি— অর্থাৎ প্রকৃত অর্থেই উদিত হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য। ভুট্টোসহ পাকিস্তানের অধিকাংশ নেতা এ অবস্থা কখনো মেনে নিতে পারে না।
ততদিনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও সংসদে ৮১টি আসন নিয়ে সম্ভাব্য বিরোধী দলীয় নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো বুঝে গেছেন যে, পাকিস্তানের বহু নেতা, যেমন— সিন্ধু প্রদেশে জনাব জি এম সৈয়দের অনুসারীগণ ছাড়াও জনাব আইয়ুব খুরো, বেলুচিস্তানের সর্বজনাব গউস বক্স বেজেঞ্জো, আতাউল্লাহ খান মেঙ্গেল ও খায়ের বক্সমারী, জমিয়ত নেতা মুফতি মোহাম্মদ, সীমান্তগান্ধী খান আব্দুল গাফফার খানের ছেলে জনাব ওয়ালী খানের দল, এমনকি খোদ পাঞ্জাবের গণপরিষদের কয়েকজন সদস্য (গুজব ছিল যে মিয়া মমতাজ দৌলতানা পর্যন্ত!) নাকি বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন দিতে তলে তলে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন।
তাই তো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা ডেজিগনেটেড প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরামর্শমতে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন না ডেকে সংখ্যালঘু দলনেতা জুলফিকার আলীর কথামতো ৩ মার্চ অধিবেশনের ঘোষণা দেন । ইয়াহিয়া ভুট্টো মিলে আঁতাত করেছিলেন যে, বাড়তি সময় নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে শেখ মুজিব অনুসারীদের ‘ম্যানেজ’ করা সম্ভব হবে
ঘটনাপ্রবাহ আমরা সবাই জানি। ইয়াহিয়া-ভুট্টো আঁতাতের ফল উল্টো দিকে চলে যাচ্ছিল । রাজনৈতিক ভাষ্যকারগণ মনে করছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবেন এবং সংবিধান সংশোধন করে প্রথম অধিবেশনেই পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করবেন। তার চেয়েও বড়ো কথা, ছয় দফার পূর্ণ বাস্তবায়নে:
(ক) পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আলাদা সেনাবাহিনী গঠন করা হবে।
(খ) দুই প্রদেশে দুই রকম মুদ্রাব্যবস্থা তথা অর্থনীতি চালু করা হবে।
(গ) জনসংখ্যার অনুপাতে বাজেট বরাদ্দ করা হবে এবং
(ঘ) পূর্ব পাকিস্তান যাতে স্বাধীনভাবে বহির্বাণিজ্য করতে পারে তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ১ মার্চ দুপুর সাড়ে বারোটায় ঢাকায় অনুষ্ঠিতব্য ৩ মার্চের গণপরিষদ অধিবেশন স্থগিত করে দেন।
ওইদিনই বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। সেদিন থেকেই মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথে আরো এক ধাপ এগিয়ে যায় লক্ষণীয় যে, ওই সময়টাতে বাংলাদেশের সকল রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম জাতির পিতার নির্দেশে চলতে থাকে। ভুট্টোর ‘পা কেটে দেওয়ার হুংকার’ এবং ‘রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবার হুমকি উপেক্ষা করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গণপরিষদের ৩৫ জন সদস্য ৩ মার্চ আহূত অধিবেশনে যোগ দিতে ঢাকায়ও আসেন।
এর মধ্য দিয়ে তারা শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বকে মেনে নিতে চেয়েছিলেন । সংসদ বসলে যে প্রকৃতপক্ষেই স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়ে যেত সে উপলব্ধি থেকেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা দেন। এর পর ঢাকার রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণার ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলার জনমানুষেরা ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের মরণপণ লড়াইয়ে ।
[ ‘তিনি আমার কথা রাখলেন না। তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা।’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] ]
লেখক: ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন
চেয়ারপারসন, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি
সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক
আরও পড়তে পারেন :