‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] আবুল মোমেন

বঙ্গবন্ধু তার ৭ই মার্চের ভাষণে বলেন – ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়’

বঙ্গবন্ধু যা বলছেন তা শেষ কথা। এখানে। কোনো দরকষাকষির ব্যাপার নেই। অবশ্যম্ভাবীর কথা বলা হচ্ছে । যা করণীয় তারই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে । আর গুলি চললে, আবার গুলি ছুঁড়লে এবার মানুষ বসে থাকবে না। তারা স্বাধীনতার পথেই হাঁটবে ।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

বঙ্গবন্ধু গোড়া থেকেই জনগণের সঙ্গে থেকে রাজনীতি করেছেন । তাঁর কর্মী, সমর্থক ও গণমানুষের উপকার এবং সেবা ও অধিকার আদায়ের জন্যেই তিনি রাজনীতির পথে গেছেন । নিজের ওপর নিজের চাপানো দায় সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বরাবরই সচেতন ছিলেন । তাই এ পথে কোনো বাধা এলে তিনি তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। এ কারণে তিনি একজন দায়বদ্ধ রাজনীতিক- যার প্রথম দায় মানুষের কাছে, তারপর মানুষের স্বার্থেই দেশের কাছে মানুষের কল্যাণে প্রয়োজনে তিনি দেশের রূপান্তরে, অন্য কথায় স্বাধীনতার জন্যে কাজ করেছেন ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতবর্ষ ভাগের আগে পাকিস্তানের পক্ষে লড়েছেন । আবার সেই পাকিস্তান যখন বাঙালির স্বার্থবিরোধী অবস্থান নিল, পূর্ব বাংলায় শোষণ-বঞ্চনা-লাঞ্ছনা চালাতে লাগল, তখন তিনি পাকিস্তান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষে রাজনীতি শুরু করলেন।

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেভাবে মোকাবিলা করেছেন তাতেই তিনি এদেশের পূর্বাপর সকল নেতাকে ছাপিয়ে উঠলেন। তখনই বোঝা গিয়েছিল তিনি অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্যে কী ভূমিকা নিতে পারেন, কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন। একদিকে অত্যাচার, অপমান, মৃত্যুর হুমকি অন্যদিকে ক্ষমতা আর প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রলোভন! বঙ্গবন্ধু এক চুল টলেননি। তিনি তাঁর জনগণের ওপর ভরসা রেখেছেন, আর জনগণ ভরসা রেখেছিল তাঁর ওপর এর আগে বাংলার জনগণ রাজনীতিবিদদের দোলাচল, আপস এবং নানান দুর্বলতা দেখে অনেকটাই হতাশ ছিল।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এলেন তখন তারা বুঝলেন, এই নেতার কাছে কিছু আশা করা যায় তারা উপলব্ধি করতে পারলেন, এই নেতা তাদের স্বার্থ বিকিয়ে দেবেন না; এঁর কোনো ব্যক্তিগত চাওয়া নেই, এজেন্ডা নেই। মুজিবই যেন বাংলাদেশ, বাংলাদেশের সকল মানুষের প্রতিনিধি। তাই ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান পর্বে মুক্ত মুজিব জনগণের নয়নের মণি, ঐক্যের প্রতীক, বঙ্গবন্ধু।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন রেসকোর্সের ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছেন ততদিনে বাঙালি এক জাতি, এক প্রাণ তারা এক নেতার পেছনে কাতার বন্দি হয়ে দাঁড়ানো। ৭ই মার্চের ভাষণের আগে মানুষ পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য করে মুজিব-তাজউদ্দীনের নির্দেশেই চলেছে। ততদিনে ১৪৪ ধারাকে তারা গণ্যই করে না, কারফিউ ভেঙে নির্ভয়ে মিছিল করে। মিছিলে তারা হাঁটে না, দৌড়ায়। তাদের বড্ড তাড়া, তারা দেখতে পায় সুড়ঙ্গের ওপারে স্বাধীনতার সূর্যের লালিমা। কী করে তারা ধৈর্য ধরে। এই টগবগে স্বাধীনতাকামী লাখো জনতার সামনে সেদিন দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন জাতির জনক ।

৭ই মার্চের ভাষণে তিনি আবেগ ও যুক্তির সংমিশ্রণে স্বপ্ন ও বাস্তব, লক্ষ্য ও পথ, সংগ্রাম ও দায়িত্ব, অভিযাত্রা ও গন্তব্য, বীরত্ব ও ত্যাগের কথা বললেন। যেন পাকিস্তানি দুঃশাসনের রেখাচিত্র এঁকে জননায়ক তার অনুসারীদের পথের দিশা দিলেন, এঁকে দিলেন চূড়ান্ত গন্তব্যের পথরেখা।

৭ই মার্চের ভাষণে প্রতিপক্ষ পাকিস্তানি দুঃশাসকদের দিকে চোখ রেখেই তিনি বললেন অনেক কথা। সামরিক স্বৈরশাসককে শাসিয়ে জানিয়ে দিলেন, এদেশের প্রতিটি মানুষ তাঁর সন্তান। তাদের অভিভাবক হয়ে বঙ্গবন্ধু সেদিন বজ্রকণ্ঠে ধমক দিয়ে বললেন আমার সন্তানদের ওপর আর একটা গুলিও চালানো যাবে না, অনেক হয়েছে। আর একটি প্রাণও যদি নষ্ট হয় তবে কঠিন পরিণতির হুঁশিয়ারি দেন জাতির জনক ।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

হ্যা এই ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন জাতির জনক ।

সবার দায় তিনি গ্রহণ করলেন, সবার অভিভাবক হয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সওয়াল করলেন । তিনি যখন বললেন- ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়’ তখন তাঁর আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে ফুটে উঠল প্রকৃত জননেতার প্রত্যয়দৃঢ় স্বর । এটা সম্ভব হয়েছে, কারণ তিনি তাঁর বক্তব্য এবং তাঁর ও জনগণের অভিপ্রায়ের সত্যতায় অকুণ্ঠ বিশ্বাসে বলীয়ান। তার ব্যক্তিত্বে তখন কর্তৃত্বের সারল্য ও দৃঢ়তার অভূতপূর্ব এক মিশ্রণ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ়, অথচ সরল; তিনিই ক্ষমতা, তিনিই কৰ্তৃত্ব; তথাপি তিনিই আবার জনতার একজন । তিনি তাঁর জনগণের দাবি তুলে ধরলেন। তাদের মনের কথা বললেন পাকিস্তান আর আমাদের কর্তৃপক্ষ নয় । তাই তাদের কাছে যাচঞা নেই, কামনা নয়, কেবল জানিয়ে দেওয়া।

বঙ্গবন্ধু যা বললেন তা শেষ কথা। এখানে কোনো দরকষাকষির ব্যাপার নেই । অবশ্যম্ভাবীর কথা বলা হচ্ছে। যা করণীয় তারই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আর গুলি চললে, আবার গুলি ছুঁড়লে এবার মানুষ বসে থাকবে না । তারা স্বাধীনতার পথেই হাঁটবে।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুর কথা রাখেনি, তাঁর কর্তৃত্বকে মানেনি, বোঝেনি। জনগণ তাঁর কথা রেখেছে, তারা পাকিস্তানের গুলিকে ভয় পায়নি, গুলিতে আর মৃত্যুতে তারা দমে যায়নি, পিছু হটেনি। তাদের ব্রত তারা থামায়নি, নেতাকে অসম্মান করেনি, নেতার মতোই মৃত্যুর পরোয়া না করে দেশের জন্য বীরের মতো দাঁড়িয়েছে রণাঙ্গনে। এবং বিজয় না হওয়া পর্যন্ত নড়েনি, টলেনি। ঠিক যেমন নেতা মৃত্যুর পরোয়ানার মুখেও টলেননি, নড়েননি । আপসের প্রলোভনের ফাঁদে বঙ্গবন্ধু কখনো পা দেননি, জনগণও সে পথে পা বাড়ায়নি।

বঙ্গবন্ধু আর জনগণ সেদিন এক হয়ে গিয়েছিল । এ ভাষণ নেতা-জনতার একাকার হওয়ার সেই সাক্ষ্য। পাকিস্তান বঙ্গবন্ধুর কথা ও নির্দেশনা শোনেনি, গুলি চালিয়েছে, হত্যা করেছে তাঁর সন্তানদের। এর পরিণতিতে সেই রেসকোর্সের ময়দানেই নয় মাস পরে তাদের সেনাপতিসহ সকল অফিসারের উর্দির ব্যাজ খুলতে হয়েছে। খুলতে হয়েছে বেল্ট এবং মাথা নিচু করে আগ্নেয়াস্ত্রগুলো বাংলার সবুজ ঘাসের গালিচায় শুইয়ে দিতে হয়েছে ।

বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে শিরোনামে বিধৃত বক্তব্য উচ্চারণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানকে একটি সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন । নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর সেই সতর্কবার্তা বাস্তব রূপ লাভ করে, বাঙালি পায় স্বাধীনতা, পায় মুক্তির স্বাদ ।

[ ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ]]

লেখক: আবুল মোমেন
কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক

‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] আবুল মোমেন
‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] আবুল মোমেন

আরও পড়তে পারেন :

Leave a Comment