২৩ বছরের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের বুকের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস – বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য একটি বাক্য –
তাঁর দেওয়া ১৯ মিনিটের ভাষণে ‘২৩ বছরের ইতিহাস’ কথাটি দুবার এসেছে । তিনি তাঁর মূল বক্তব্যে পৌছার আগে বাংলার মানুষের অভিজ্ঞতা পটভূমি হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন এবং ঐ বাক্যটি উচ্চারণের পর তা বিস্তৃতও করেছেন । বাংলার মানুষের ২৩ বছরের ইতিহাসতো রাজপথ রঞ্জিত করারই ইতিহাস ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের প্রথম বাক্য ‘বাংলার ইতিহাস এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস।’ তবে লাইনটি বিশ্লেষণের আগে ভাষণ শুরুর আগের মুহূর্তটা উল্লেখ করতে চাই।
৭ই মার্চের ভাষণের দিন দুপুর থেকে ঢাকা শহরের অজস্র মানুষ এগুতে থাকে রমনা রেসকোর্সের দিকে। দুপুর তিনটার মধ্যে রেসকোর্স লোকে লোকারণ্য সারা দেশ অপেক্ষা করছে, কী বলবেন বঙ্গবন্ধু? বেলা তিনটার খানিক পর তাঁর সেই পুরনো মডেলের টয়োটা গাড়িতে এসে নামেন মঞ্চের কাছে।
৭ই মার্চের ভাষণে তিনি তাঁর মূল বক্তব্যে পৌছার আগে বাংলার মানুষের অভিজ্ঞতা পটভূমি হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন এবং ওই বাক্যটি উচ্চারণের পর তা বিস্তৃতও করেছেন। বাংলার মানুষের ২৩ বছরের ইতিহাস তো রাজপথ রঞ্জিত করারই ইতিহাস।
বঙ্গবন্ধু মঞ্চে ওঠেন। সারা মাঠ স্লোগান আর করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি আর কালো কোট পরনে। সভায় কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই। কালো ভারি ফ্রেমের চশমাটি খুলে রাখেন ঢালু টেবিলের ওপর । তারপর সামনে তাকিয়ে শান্ত-গম্ভীর কণ্ঠে শুরু করেন, ‘ভায়েরা আমার! আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি । আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। সারা মাঠ হঠাৎ শান্ত । শুধু চারদিকে আছড়ে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর ভরাট কণ্ঠস্বর ।
কেন আজ এই অবস্থা, ৭ই মার্চের ভাষণে প্রথমে তার একটি বর্ণনা দিলেন বঙ্গবন্ধু । বাঙালি আর কিছু নয়, শুধুমাত্র তার অধিকার চেয়েছে সব সময়, আর এজন্যই অত্যাচার সইতে হয়েছে। ভোট হয়েছে, বাঙালি জিতেছে। কিন্তু এখনো তাদের ক্ষমতায় বসতে দেওয়া হয়নি। তিনি বললেন, ‘আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস, মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস।’ ভাষণে ‘২৩ বছরের ইতিহাস’ কথাটি দুবার এসেছে ।
৭ই মার্চের ভাষণে তিনি তাঁর মূল বক্তব্যে পৌছার আগে বাংলার মানুষের অভিজ্ঞতা পটভূমি হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন এবং ওই বাক্যটি উচ্চারণের পর তা বিস্তৃতও করেছেন। বাংলার মানুষের ২৩ বছরের ইতিহাস তো রাজপথ রঞ্জিত করারই ইতিহাস। মূল বক্তব্যে যাওয়ার আগে এই বাক্যেই তিনি বাঙালির ২৩ বছরের অভিজ্ঞতা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন; যার ফলে সব শেষে মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামর আহ্বানটি মানুষের উপলব্ধিতে যথাযথভাবে অভিঘাত সৃষ্টি করে ।
১৯৭১ সালে পৌছার আগে মাইলফলক যে ঘটনাগুলোতে বাংলার মানুষের বঞ্চিত হওয়ার ইতিহাস বিধৃত রয়েছে তা সংক্ষেপে উল্লেখ করা যেতে পারে :
১. ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন
২. ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে জয়লাভের পরও প্রাদেশিক সরকার বাতিল
৩. একইভাবে ১৯৫৬ সালেও ঘটনার পুনরাবৃত্তি
৪. ১৯৫৬ সালে পূর্ব বাংলার নাম বদল
৫. ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি করে দমন পীড়ন
৬. ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান কমিশনবিরোধী আন্দেলন
৭. ১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধের সময় পূর্ব বাংলা অরক্ষিত রাখা
৮. ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন
৯. ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধকরণ
১০.১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার
১১. ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান
এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশের রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে বাঙালি শহিদের রক্তে। উল্লিখিত ঘটনাগুলোতে প্রচুর রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, জুলুম চালানো হয়েছে। এমনকি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সত্ত্বেও ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি পশ্চিম পাকিস্তানিরা । বরং ১৯৫৪ ৫৬ সালের মতো ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এসব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বাঙালি আর পিছু হটতে রাজি হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়, ‘কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবা না।’
লেখক : মুনতাসীর মামুন
অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়তে পারেন :
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী; সময়রেখা
- বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন : মাতৃভূমির পবিত্র মাটিতে বঙ্গবন্ধু – এইচ. টি. ইমাম