বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এর পঙক্তি ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’ নিয়ে লিখেছেন – কামাল লোহানী।
‘জনগণের ওপর আস্থা না থাকলে কারও পক্ষে এমন উচ্চারণ সম্ভব নয় । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা এবং ঐতিহাসিক ৬ দফার প্রবক্তা। ওই ৬ দফা ছিল বাংলার মানুষের মুক্তি সনদ। বাঙালি জাতির কল্যাণ কামনায় তিনি নিজেকে নিবেদন করেছিলেন জনগণের রাজনীতিতে। তাই মহিমান্বিত ত্যাগের ঘোষণা দিতে তিনি ছিলেন দ্ব্যর্থহীন ।
বাংলার রাজনীতিতে ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তানি আমলে কোনো রাজনীতিক কি এমন পর্যায়ে উন্নীত হতে পেরেছিলেন? সংসদীয় রাজনীতি অঙ্গনে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার এই বলিষ্ঠতা একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই দেখাতে পেরেছিলেন বলে তিনি জাতি-রাষ্ট্র-স্রষ্টা এবং মুক্তিদাতা হিসেবে মহত্ত্ব অর্জন করেছেন। তাই তো তিনি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার কথা চিন্তা করতেন, বলতেন এবং করে দেখিয়েও গেছেন ।
শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক কর্মী-সংগঠক হিসেবে অসাধারণ দক্ষতা নিয়ে আপন প্রতিভাগুণে রাজনীতি অঙ্গনের অপরিহার্য এক নেতায় যখন পরিণত হলেন, তখন তাঁকে অতিক্রম করে যাওয়া ছিল কঠিন। তিনি তাঁর সময়ের সমসাময়িক নেতৃত্বের মধ্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলেন সাহসে ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব গুণে ।
সংসদীয় রাজনীতি অঙ্গনে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার এই বলিষ্ঠতা একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই দেখাতে পেরেছিলেন বলে তিনি জাতি-রাষ্ট্র-স্রষ্টা এবং মুক্তিদাতা হিসেবে মহত্ব অর্জন করেছিলেন ।
ছোটবেলা থেকে ক্রমশ বড়ো হয়ে ওঠার পেছনে যে আত্মপ্রত্যয় ও দৃঢ় মনোবল, সাহস ও অকপটে ন্যায় কথা বলার নৈতিক চরিত্র গঠন করেছিলেন, সেই বলিষ্ঠতাই ছিল তাঁর রাজনৈতিক নেতৃত্বের শীর্ষস্থানে উঠে যাওয়ায় বড়ো উপাদান। বঙ্গবন্ধু এমনই একজন রাজনীতিক, যিনি জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে ।
কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মধ্যবিত্ত সকল মানুষের হৃদয় জয় করলেন কথা আর বক্তৃতায়। এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করলেন সমকালীন নেতৃত্বের সহযোদ্ধাদের । কালের পরিক্রমায় পাকিস্তান মুসলিম লীগের দুঃশাসন ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানই একদিন ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে অভিষিক্ত হলেন এবং জনগণ তাঁকে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে দেখলেন তিনিই মাতৃভূমিকে আইয়ুব-ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার আঞ্চলিক ও সাম্প্রদায়িক জনপ্রশাসন থেকে পুনরুদ্ধার করলেন স্বল্পস্থায়ী এক সশস্ত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমে।
‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’
আর এই জনযুদ্ধকেই আমরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বলি ইতিহাসের অবধারিত পরিণতির এক গৌরবোজ্জ্বল অথচ রক্তক্ষয়ী চূড়ান্ত লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে মাত্র নয় মাস এই যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল কিন্তু মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়েছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পর থেকেই ৷ এই সংগ্রামের সূচনা করেছিল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ।
দেশে প্রথম মুসলিম লীগ শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ এবং প্রথম বিরোধী সংসদীয় রাজনৈতিক দল। শেখ মুজিব কারান্তরালে থাকা সত্ত্বেও ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী তাঁকে দলের যুগ্ম সম্পাদক পদে মনোনীত করেছিলেন ৷ তরুণ ছাত্রনেতার সাহসী সাংগঠনিক নেতৃত্বগুণ এবং ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত করার দক্ষতা বিচার করেই জেলে থাকা সত্ত্বেও শেখ মুজিবকে প্রথম যুগ্ম-সম্পাদক খোন্দকার মোশতাক দ্বিতীয় স্থানে আহমদকে রেখেছিলেন ।
এজন্য মুশতাক আহমেদ ক্ষুব্ধও হয়েছিলেন। এ সময় মওলানা তাঁকে স্বভাবসুলভ ধমক দিয়ে থামিয়ে যে জবাব দিয়েছিলেন, তা হলো ‘মুজিব জেলে আছে, তাঁর মুক্তির দাবির জন্যই তাঁর নাম আগে রেখেছি’। এরপর ভাসানী মোক্ষম যে প্রশ্নটি করেছিলেন, সেটি হলো ‘পারবে তুমি (খোন্দকার মোশতাক) মুজিবুরের মতোন সাংগঠনিক ‘দক্ষ হতে?’
প্রসঙ্গত বলে রাখি, খোন্দকার মোশতাক আহমদ তখন থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখলেও ভেতরে ভেতরে বৈরী মনোভাব পোষণ শুরু করেন । এদিকে মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইলের শামসুল হককে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করেছিলেন ।
শামসুল হক প্রতিভাধর গুণী রাজনৈতিক সজ্জন ছিলেন। ছিলেন সুবক্তা । প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি । কিন্তু দীর্ঘকাল জেলে থাকায় এবং পারিবারিক বিপর্যয়ের কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললে আওয়ামী মুসলিম লীগ পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমানকেই সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করেন ।
মওলানা ভাসানী দূরদর্শী নেতা হিসেবে যাকে যুগ্ম-সম্পাদক হিসেবে মনোনীত করেছিলেন, তিনিই সাধারণ সম্পাদকের পদ গ্রহণ করে দলকে সুসংগঠিত করে তুললেন।
পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে বাঙালির রুখে দাঁড়াবার সময় এল ১৯৫২ সালে, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবি থেকে জেল-জুলুম এবং রক্তদানের বিপুল বৈভবে আমরা মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করলাম। শেখ মুজিব ওই সময় জেলে থাকলেও ছাত্রনেতা হিসেবে যোগাযোগ রক্ষা করেই যাচ্ছিলেন এবং সেটাই ছিল স্বাভাবিক।
অবিভক্ত বাংলার মুসলিম নেতা ও বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৬ সালে কুখ্যাত ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গার সময় যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সেখানেও শেখ মুজিবের বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল; তেতাল্লিশে মানুষসৃষ্ট ভয়াবহ মন্বন্তরে কয়েক লাখ মানুষের নৃশংস মৃত্যু ছুঁয়ে গিয়েছিল তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবের হৃদয়।
এরপর থেকে ছাত্রনেতা হিসেবে উদারপন্থী-তুলনামূলকভাবে প্রগতিশীল অংশের সঙ্গে যুক্ত থেকেই রাজনীতির জীবন গড়ার ছবক নিয়েছেন সাধারণ মানুষের কাছে তাই তো বিভাগোত্তর পূর্ববাংলায় প্রথম মুসলিম লীগ বিরোধী আওয়ামী মুসলিম লীগ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমান পালন করেন অন্যতম প্রধান ভূমিকা ।
পরবর্তীকালে সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীর যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে শেখ মুজিব রাজনীতির মাঠে হয়ে ওঠেন অবিসংবাদিত নেতা নেতৃত্ব শেখ মুজিবকে শুধু সাহসী ও বলিষ্ঠ সংগঠকেই পরিণত করেনি তিনি যে মানুষের ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন, সেই অগণিত দুঃখী মানুষই তাঁকে ভালোবেসে গ্রহণ করেছিল ।
এ জন্যই ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ দশ লাখ মানুষের গণসমাবেশে বারবার উচ্চারিত হয়েছে ‘তোমার নেতা, আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।’ রেসকোর্স ময়দানের লাখো মানুষের ঢল বজ্রনির্ঘোষে বলেছেন ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, । ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’।
এমন বিক্ষুব্ধ জনতার বিপুল উপস্থিতির স্বতঃস্ফূর্ততা কি মহান এই নেতার সাহসেই সৃষ্টি হয়নি? তাঁর কথা শুনবার জন্য, তাঁর পথনির্দেশ নেওয়ার উদ্দেশ্যেই সকল পেশা ও শ্রেণির মানুষ সেদিন একত্র হয়েছিলেন ।
জনগণকে বিশ্বাস করেই সেদিন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামের কথা। এই চূড়ান্ত বাণী ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ নয়, তবুও তিনি পাকিস্তানি চক্রের হাতে গ্রেফতার হবার আগেই ‘ঈপ্সিত ঘোষণা দিয়ে গেলেন তাঁর দৃঢ়প্রত্যয়ী জনগণকে। অমিত তেজ বাংলার সাধারণ মানুষ তাঁদের নেতার অকুতোভয় উচ্চারণকে বুকে ধারণ করেই তাঁর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধে লড়েছিল ।
বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতার বাণী ও লক্ষ্যকে পথনির্দেশ হিসেবে নিয়ে সেদিন কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, নারীসহ সকল স্তরের জনতা ঝাপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে । জনতার এমন নেতাই তো অকপটে বলতে পারেন, আমি ক্ষমতা চাই না। মানুষের অধিকার চাই।
বঙ্গবন্ধুর অগাধ বিশ্বাস ছিল জনগণের ওপর এবং জনগণও তাঁকে অবিসংবাদিত-অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে বিশ্বাস করেছিল। আর এজন্যই ওই সময় সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমাসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান ও তৎসংশ্লিষ্ট মানুষ নেতার নির্দেশ কায়মনোবাক্যে পালন করেছিলেন শেখ রহমান তাঁর জীবদ্দশায় আপসহীন চরিত্রের পরিচয় দিয়েছেন।
রাজনীতিতে তাঁর প্রগতিশীলতা, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, সমাজতন্ত্রের প্রতি আগ্রহ এবং মানুষের প্রতি মমত্ববোধ প্রতিনিয়ত প্রমাণিত হয়েছে । তিনি চেয়েছিলেন দেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে ৷ আর মুক্তিযুদ্ধে সেই মানুষের প্রবল শক্তির উৎস ছিল বঙ্গবন্ধুর বাণী ও নির্দেশ।
এমন নেতাই তো সাধারণ মানুষের মনের মণিকোঠায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকে অনাদি-অনন্তকাল । … হে বঙ্গবন্ধু, তুমি যাদের ভালোবেসে দিয়ে গেলে প্রাণ, তাঁদের বিশ্বাসে তুমি আজও চির অম্লান । বাংলার মাটি, বাংলার জল, অবারিত মাঠ, গগন ললাট গাইছে জীবনের গান, লড়ছে মানুষের কল্যাণে এরা যে সবাই তোমারই দুঃখী মানুষ, আজও সংগ্রাম করে যাচ্ছে তোমার সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য।
কারণ তোমাকে ওরা পেয়েছে জাতির জনক হিসেবে, আর পেয়েছে তোমার সেই ঐতিহাসিক বাণী ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না । আমরা বাংলার মানুষের অধিকার চাই ।’
লেখক : কামাল লোহানী
সাংবাদিক ও সাবেক মহাপরিচালক, শিল্পকলা একাডেমী
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বিষয়ে আরও পড়তে পারেন :