‘জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] তোফায়েল আহমেদ

‘জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে’ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এর পঙক্তি বিশ্লেষন করেছেন তোফায়েল আহমেদ।

১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের বিশ্বনন্দিত ঐতিহাসিক ভাষণে, পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চারটি শর্ত দিয়েছিলেন ।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
  • এক. সামরিক আইন মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে;
  • দুই. সামরিক বাহিনীর সমস্ত লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে;
  • তিন. যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে;
  • চার. জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে ।

এই চারটি শর্ত জুড়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দেন। শর্ত মানলে পাকিস্তান টিকবে; অন্যথায় মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রাম এর মাঝামাঝি কোনো পথ নাই ।

ভাষণের শুরুতেই বাংলার মানুষের দীর্ঘদিনের সংগ্রামী আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলব। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে ।

কিন্তু গণআকাঙ্ক্ষার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে সামরিক শাসকগণ পূর্বে আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন একতরফাভাবে স্থগিত ঘোষণা করে। তারা ‘জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর’ না করে হত্যা-নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নেয়। অথচ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ৬ দফা ও সংগ্রামী ছাত্রসমাজের ১১ দফাকে রেফারেন্ডামে পরিণত করে ‘৭০-এ অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিয়েছিল গণতন্ত্রের জন্য, শাসনতন্ত্র তৈরির জন্য।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে চারটি শর্তের মধ্যে রাজনৈতিক বৈধতা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদের দায়মুক্ত শর্তটি ছিল ‘জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে ।

পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্রের মনোভাব নিয়ে নির্বাচনি ফলাফল বানচাল করতে নানামুখী নীলনকশা বাস্তবায়নে অগ্রসর হতে থাকে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া যাবে না। পক্ষান্তরে বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ে বঙ্গবন্ধু ছিলেন বদ্ধপরিকর। আর সেজন্যই তিনি শত প্রতিকূলতার মধ্যেও এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির লক্ষ্যে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঐতিহাসিক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন নির্বাচনের ফলাফল নিরঙ্কুশভাবে আওয়ামী লীগ তথা বাংলার মানুষের পক্ষে এলে পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ হতভম্ব হয়ে পড়ে এবং জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানে নানারকম টালবাহানা করতে থাকে।

মার্চের ৩ তারিখে আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১ তারিখে স্থগিত করে দেওয়া হয় । অথচ বঙ্গবন্ধু বিরোধী নেতাসহ সকলকে আশ্বস্ত করে গণতন্ত্রের মহানুভব ঔদার্য প্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আমি বললাম, অ্যাসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব, এমনকি আমি এও পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজনও যদি হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।’ আসলে জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে সামরিক কর্তৃপক্ষের টালবাহানা বঙ্গবন্ধু আগেই উপলব্ধি করেছিলেন। এবং তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে ওরা ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না।

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে চারটি শর্তের মধ্যে রাজনৈতিক বৈধতা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদের দায়মুক্ত শর্তটি ছিল ‘জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীগণ ‘৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয় ফলে নির্বাচনি রায়ে বাঙালির স্বাধিকারের প্রশ্নে জাতিগত অধিকারের পক্ষে বঙ্গবন্ধু Political Legitimacy তথা রাজনৈতিক বৈধতা অর্জন করেন।

এই রাজনৈতিক বৈধতাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আমাদের স্বাধীনতার অনুকূলে বিশ্বজনমত গঠনে শক্তি যোগায়। সুতরাং, ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে চারটি শর্তের অন্যতম এই শর্তটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রজ্ঞাবান ও দূরদর্শী রাজনীতিক বঙ্গবন্ধু বাঙালির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে সূচনালগ্ন থেকেই ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হন এবং চারটি শর্ত আরোপ করে দেশের পরিপূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণার বৈধতা অর্জন করেন।

[ ‘জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] ]

লেখক : তোফায়েল আহমেদ
মন্ত্রী, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

তোফায়েল আহমেদ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন।

‘জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] তোফায়েল আহমেদ
‘জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] তোফায়েল আহমেদ

 

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বিষয়ে আরও পড়তে পারেন :

 

Leave a Comment