‘আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি’ – বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এর এই অংশটি বিশ্লেষন করেছেন ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণের শুরুতে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাস দশটি বাক্যে প্রকাশ করেছেন। পরবর্তী বাক্যগুলোও অত্যন্ত সুবিন্যস্তভাবে উপস্থাপন করেছেন যে তা আমাদের মুক্তিসংগ্রামের অনন্য এক দলিল । এই ভাষণের প্রতিটি বাক্য বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
১৯৭১ সালের ১ থেকে ২৫ মার্চ যে সরকার ছিল সে সরকারে বঙ্গবন্ধু শুধু Defacto প্রধানই ছিলেন না, কার্যত আইনগতভাবে বৈধ সরকারের প্রধান ছিলেন । বরং ইয়াহিয়া খানের সরকার ছিল অবৈধ । [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বিষয়ে আমীর-উল ইসলাম ]
৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি। তিনি ভালো করেই জানতেন, পাকিস্তানি স্বৈরশাসকরা তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সম্মত হবে না জুলফিকার আলী ভুট্টো তা করতে দেবেন না।
কারণ শাসনতন্ত্র তৈরি হলে তাতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বার্থ ও অধিকার সংরক্ষিত হবে বঙ্গবন্ধু ২৩ বছরের ধারাবাহিক আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বাঙালির মুক্তি সনদ (ম্যাগানকার্টা) ৬ দফা ঘোষণা করেছিলেন সনদের প্রথম দফায় শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতির কথা উল্লেখ করা হয়।
এতে বলা হয়, ‘দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এমন হতে হবে, যেখানে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশনভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং তার ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। সরকার হবে পার্লামেন্টারি ধরনের । আইন পরিষদের (Legislatures) ক্ষমতা হবে সার্বভৌম। এবং এই পরিষদ নির্ধারিত হবে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনসাধারণের সরাসরি ভোটে।’
৬ দফার অন্য দফাগুলোতে মুদ্রা বা অর্থ, রাজস্ব কর বা শুল্ক, বৈদেশিক বাণিজ্য ও আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা কীরূপ হবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত ৬ দফা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব দেন ।
৬ দফা এবং পরবর্তীকালে ১১ দফা দাবি আদায়ের আন্দোলন থেকে সংঘটিত হয় ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ‘৭০-এর নির্বাচন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করে। এই নির্বাচনের মধ্য দিয়েই বাঙালিদের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু জনগণের একচ্ছত্র নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।
‘৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ের পর পরই বঙ্গবন্ধু ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নেন। ওই সময় কাজটি ছিল অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং । তিনি ড. কামাল হোসেন ও আমাকে সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব দেন । আর এ সংবিধান প্রণয়নে অর্থনৈতিক বিষয়ে আমাদের পরামর্শ দেন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ ড. নুরুল ইসলাম, রেহমান সোবহান, ড. মোশাররফ হোসেন ও ড. আনিসুর রহমান।
একই দেশে দুই ধরনের মুদ্রা চালু রেখে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কীভাবে বৈদেশিক সাহায্য সমন্বয় করা হবে, কীভাবে মূলধন পাচার রোধ করা সম্ভব হবে- সে বিষয়ে তারা বিশেষজ্ঞ মতামত প্রদান করেন। তবে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নে বিভিন্ন শব্দ প্রয়োগ ও বিশ্লেষণে আমাদের সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেন বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন আহমেদ । ফলে সংবিধান রচনার কাজটি আমাদের জন্য সহজ হয়ে যায় ।
এছাড়া আইয়ুব খানের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠকে আমরা এটা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলাম যে, শেখ মুজিব ছাড়া পাকিস্তানের সাংবিধানিক সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। বৈঠকে আইয়ুব খান পাকিস্তানের যে সংবিধান আছে তা সংশোধন করে ৬ দফা এবং ১১ দফার কোন কোন পয়েন্ট সংযোজন করা যায় তা খতিয়ে দেখার জন্য বলেন।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ড. কামাল হোসেন ও আমি সংশোধনীগুলো তৈরি করি পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ নেতা সবুর খান ওয়াহিদুজ্জামানেরা বলতে শুরু করলেন যে, তারা পাকিস্তানের সংবিধানের কোনো সংশোধনী মানতে বাধ্য নন। এরপরই ইয়াহিয়া খান আইয়ুবকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করলেন।
ক্ষমতাসীন হয়েই ইয়াহিয়া লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার জারি করলেন এবং ‘ওয়ান ম্যান, ওয়ান ভোট’ মেনে নিলেন। ইয়াহিয়া খানের ধারণা ছিল, নির্বাচন হলে মুসলিম লীগ এবং জামায়াত মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করবে । কিন্তু ফল হলো উল্টো ।
নির্বাচনে জয়লাভের পর পরই বঙ্গবন্ধু শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ওপর জোর দেন। লক্ষ্য সংসদের প্রথম অধিবেশনই শাসনতন্ত্র পাস করিয়ে নেওয়া। ৩ মার্চ সংসদের অধিবেশন আহ্বান করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রস্তুত ওই অধিবেশনেই শাসনতন্ত্র উত্থাপনের জন্য। তিনি নির্দেশ দিলেন সংসদীয় দলের মিটিং ডাকার ।
১ মার্চ পুরানা পল্টনে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির এবং পূর্বাণী হোটেলে হয় সংসদীয় দলের সভা। পূর্বাণী হোটেলের সভায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত সরফরাজ খানসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন । সংসদীয় দলের সভায় যখন সর্বসম্মতভাবে খসড়া সংবিধান পাস হতে যাচ্ছে, তখনই ইয়াহিয়া খান রেডিওতে অনির্দিষ্টকালের জন্য সংসদ অধিবেশন বন্ধের ঘোষণা দেন।
সঙ্গে সঙ্গে ওই মিটিংয়ে দুটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এক. ইয়াহিয়া খান কর্তৃক অনির্দিষ্টকালের জন্য সংসদ অধিবেশন বন্ধের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এবং দুই. জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সকল সদস্য কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে বঙ্গবন্ধুকে সর্বময় ক্ষমতা অর্পণ করা হয়।
১৯৭১ সালের ১ থেকে ২৫ মার্চ যে সরকার ছিল সে সরকারে বঙ্গবন্ধু শুধু Defacto প্রধানই ছিলেন না, কার্যত আইনগতভাবে বৈধ সরকারের প্রধান ছিলেন । বরং ইয়াহিয়া খানের সরকার ছিল অবৈধ । ৩ মার্চ যদি সংসদ বসত এবং সেদিন যদি শাসনতন্ত্র পাস হতো, তাহলে ইয়াহিয়া খানের সব কাজ বৈধতা পেত; কিন্তু সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণার কারণে সে বৈধতাও তিনি পাননি।
এতকিছুর পরেও অর্থাৎ প্রস্তুতকৃত খসড়া শাসনতন্ত্র হাতে থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে আলোচনার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র তৈরির কথা বলেছিলেন। এখানেই তাঁর মহানুভবতার পরিচয় মেলে।
[ ‘আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ]]
৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে এই লেখাটি লিখেছেন : ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম
আইনজীবী ও সংবিধানপ্রণেতা
আরও পড়তে পারেন :
- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী; সময়রেখা
- বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন : মাতৃভূমির পবিত্র মাটিতে বঙ্গবন্ধু – এইচ. টি. ইমাম