১৯৫২ সনে রক্ত দিয়েছি, ১৯৫৪ সনে নির্বাচনে জয় লাভ করেও গদিতে বসতে পারি নাই – বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের এই অংশটি বিশ্লেষন করেছেন আব্দুল মান্নান।
১৯৫৪ সালের ৩০ মে সরকার গঠন করার ঠিক ৫৮ দিনের মাথায় কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্টের সরকারকে ভেঙে দিয়ে পূর্ববাংলায় গভর্নর শাসন জারি করে । এ সময় প্রায় সকল রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করা হয় । এটি ছিল বাঙালি আর পূর্ববাংলার জনগণের সঙ্গে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বড় ধরনের এক প্রতারণা।
১৯৭১ সাল ঐতিহাসিক রমনা রেসকোর্সে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেওয়া বঙ্গবন্ধুর বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি যেকোনো বিচারেই, বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তো বটেই, বিংশ শতাব্দীতে সারা বিশ্বে যতগুলো রাজনৈতিক বক্তৃতা দেয়া হয়েছে তার মধ্যে অনন্য ও ব্যতিক্রম আনুমানিক ১৯ মিনিটের ওই ভাষণে একটি দেশের ইতিহাস, জনগণের প্রত্যাশা ও তাঁদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের প্রতারণা, তাঁদের ত্যাগ, আগামী দিনের জন্য দিক-নিদের্শনা ইত্যাদি বিষয় উঠে এসেছে।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন এমন একজন রাজনীতিবিদ, যিনি রাজপথ থেকে উঠে এসেছেন। দেশভাগের পূর্বে তিনি কোলকাতায় একজন ছাত্রনেতা হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, প্রমুখের নেতৃত্বে রাজপথে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন করেছেন। তিনি আজীবন গণমানুষের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলে ৭ই মার্চের ভাষণে এক নিঃশ্বাসে দেশভাগোত্তর বাঙালির বঞ্চনার ইতিহাস উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন।
৭ই মার্চের ভাষণের প্রথম দিকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “২৩ বৎসরের ইতিহাস, মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যুক্ত করেন ১৯৫২ সনে রক্ত দিয়েছি, ১৯৫৪ সনে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই।’ ৭ই মার্চের ভাষণের এই কয়েকটি লাইনে তিনি পাকিস্তান সৃষ্টির পরবর্তী তেইশ বছরে বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর শোষণ ও শাসনের কথা বলেছেন ।
অথচ ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে শুধুমাত্র অবিভক্ত বঙ্গ প্রদেশেই মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে তাদের অবস্থান জানিয়েছিল । এই সমর্থন জানানোর পেছনে বাঙালিদের বিবেচনা ছিল যে, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির জন্ম হলে তারা নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই গড়তে পারবে। কিন্তু বাঙালিদের এই ভুল ভাঙতে বেশিদিন সময় লাগেনি।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা দিলেন বহুভাষী পাকিস্তানের একটি মাত্র রাষ্ট্রভাষা থাকবে এবং তা হবে উর্দু । অথচ ওই সময় পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার মাত্র ছয় ভাগ উর্দুতে কথা বলত। এবং তাদের অধিকাংশই ছিল উত্তর প্রদেশ হতে আসা মোহাজের।
১৯৭১ সাল ঐতিহাসিক রমনা রেসকোর্সে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) দেওয়া বঙ্গবন্ধুর বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণটি যেকোনো বিচারেই, বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তো বটেই, বিংশ শতাব্দীতে সারা বিশ্বে যতগুলো রাজনৈতিক বক্তৃতা দেয়া হয়েছে তার মধ্যে অনন্য ও ব্যতিক্রম।
জিন্নাহ রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে এমন বক্তব্য দু’বার দিয়েছিলেন । একবার রমনা রেসকোর্সের জনসভায়, আরেকবার ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে। দু’বারই ঢাকার তরুণ ছাত্রসমাজ জিন্নাহ্র বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেছিল । ঢাকায় জিন্নাহর আগমনের পর পরই বাঙালিরা বুঝতে পেরেছিল তারা কীভাবে প্রতারিত হচ্ছে। জিন্নাহ্র পর ঢাকা আসেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও পরবর্তীকালে খাজা নাজিমুদ্দিন । তারাও ভাষা প্রশ্নে একই কথা বলেছিলেন।
১৯৪৮ সালে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন শুরু হলেও তা চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে । নিজের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহিদ হন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ নাম না জানা আরও অনেকে। ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে ।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে বঙ্গবন্ধু কারাগারে ছিলেন রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে। ওই সময় আন্দোলনে তিনি প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখতে না পারলেও ১৯৪৮ সাল থেকেই একজন ছাত্রনেতা হিসেবে তিনি বরাবর এই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন । তিনি কারাগারে থেকেও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।
১৯৫২ সনে রক্ত দিয়েছি, ১৯৫৪ সনে নির্বাচনে জয় লাভ করেও গদিতে বসতে পারি নাই – বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে বলেন
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববাংলার রাজনীতিতে দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে । মাওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম প্রমুখ বুঝতে পারলেন, তারা যে পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন করেছেন আর যেটি পেয়েছেন তা এক নয়। নতুন পাকিস্তানে শুধু প্রভু বদল হয়েছে। ইংরেজদের জায়গায় পাঞ্জাবি প্রভুরা স্থলাভিষিক্ত হয়েছে । তারা ধর্মকে পুঁজি করে বাঙালিদের ওপর শোষণ ও শাসন ইংরেজদের তুলনায় আরও বাড়িয়ে দেয়।
এক পর্যায়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলায় প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। যেহেতু মুসলিম লীগ পাকিস্তান আন্দোলন করে তা অর্জন করেছে এবং রাষ্ট্রক্ষমতা তাদের নিয়ন্ত্রণে সেহেতু তাদের বিরুদ্ধে একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন করতে হলে পূর্ব বাংলার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য অপরিহার্য । অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দাবির মুখে শেরে বাংলা এ কে ফজুলল হক (কৃষক শ্রমিক পার্টি), মাওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (আওয়ামী মুসলিম লীগ) এক মঞ্চে আসতে রাজি হন।
এর মধ্য দিয়ে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট । ফ্রন্টের প্রধান লক্ষ্যই ছিল বাঙালির পক্ষে ও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সকল ধরনের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে কথা বলা। যুক্তফ্রন্ট গঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘোষিত হয় বাঙালির স্বার্থ রক্ষার ঐতিহাসিক ২১ দফা। এই ২১ দফা ছিল তৎকালীন পূর্ববাংলার জনগণের মুক্তির সনদ। যুক্তফ্রন্টের ২১ দফাকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ও মুসলিম লীগ কখনো সহজভাবে নেয়নি। এ সময় তারা প্রচার করে এটি পাকিস্তানের অখণ্ডতা নষ্ট করার একটি নীল নকশা।
যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে ওই ২১ দফাকে নির্বাচনি ইশতেহার হিসেবে ব্যবহার করে। ওই সময় যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার পক্ষে প্রচার চালাতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ববাংলায় আসেন সীমান্ত গান্ধী, খান আবদুল গাফ্ফ্ফার খান, নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান, গোলাম মুহাম্মদ লুন্দখোর, মাহমুদুল হক ওসমানী, মিয়া ইফতেখার উদ্দিন প্রমুখ। অন্যদিকে মুসলিম লীগের পক্ষে প্রচারে অংশ নেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্র বোন ফাতেমা জিন্নাহ্, মিয়া মমতাজ দৌলতানা, আই আই চুন্দ্রিগড়, সরদার আবদুর রব নিস্তার প্রমুখ।
তাদের প্রচারের মূল স্লোগান ছিল যুক্তফ্রন্টকে ভোট দিলে ইসলাম ধর্ম বিপন্ন হবে, পূর্ববাংলা ভারতের অংশ হয়ে যাবে ইত্যাদি । ১৯৫৪ সালের ৮-১২ মার্চ পূর্ববঙ্গে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের প্রাক্কালে হক-ভাসানী-ে হরাওয়ার্দী ২১ দফা নিয়ে সারা গ্রাম বাংলা চষে ফেলেন। সঙ্গে ছিলেন তরুণ শেখ মুজিব, খালেক নেওয়াজ খান, শামসুল হক, অলি আহাদ, তাজউদ্দিন আহমেদ, মুহাম্মদ তোয়াহা, মহিউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ ।
২১ দফার পক্ষে সারা বাংলায় অভূতপূর্ব জোয়ার সৃষ্টি হয়। অনেক জায়গায় যুক্তফ্রন্ট নেতারা প্রচার চালানোর সময় মুসলিম লীগের গুণ্ডাদের দ্বারা আক্রান্তও হন নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হলে দেখা যায়, ৩০৯টি আসনের মধ্যে মুসলীম লীগ মাত্র ৯টি আসনে জয়ী হয়েছে।
উল্লেখ্য, নেজামে ইসলামী, গণতন্ত্রী দল ও খেলাফতে রাব্বানী পার্টিও যুক্তফ্রন্টে যোগ দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং প্রথম দুটি দল মুসলিম লীগের চেয়ে ভালো ফল করে। নির্বাচনে পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনকে পরাজিত করেন তরুণ ছাত্রনেতা খালেক নেওয়াজ খান ।
১৯৫৪ সনের ২ এপ্রিল শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে মুখ্যমন্ত্রী করে যুক্তফ্রন্ট পূর্ব বাংলায় মন্ত্রিসভা গঠন করেন, প্রাদেশিক পরিষদে মুসলিম লীগের এই শোচনীয় পরাজয় পকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসক গোষ্ঠী কখনো মেনে নিতে পারেনি। শুরু হয় ষড়যন্ত্রের রাজনীতি।
পূর্ব বাংলার বিভিন্ন শহরে কেন্দ্রীয় সরকারের প্ররোচনায় শুরু হয় বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গা। কেন্দ্র প্রচার করে যুক্তফ্রন্ট সরকার পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য কাজ করছে। ১৯৫৪ সালের ৩০ মে সরকার গঠন করার ঠিক ৫৮ দিনের মাথায় কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্টের সরকারকে ভেঙে দিয়ে পূর্ব বাংলায় গভর্নর শাসন জারি করে।
এ সময় প্রায় সকল রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। এটি ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের সঙ্গে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বড়ো ধরনের এক প্রতারণা। বঙ্গবন্ধু তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বাঙালিদের সঙ্গে বার বার প্রতারণা করেছে, প্রভুর মতো আচরণ করেছে সেই সব ঐতিহাসিক সত্য তুলে ধরেছিলেন ।
লেখক : অধ্যাপক আব্দুল মান্নান
চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)
আরও পড়তে পারেন :