‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] হাশেম খান

‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’।  বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের এই অংশটুকু নিয়ে বিশেষভাবে আলোকপাত ও বিশ্লেষণ করেছেন বিশিষ্ট শিল্পী হাশেম খান।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে ২৩ বছরের সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে যে ভাষণটি দিয়েছিলেন, তা একটি জাতির স্বাধীনতার জন্য, মানবতার মুক্তির জন্য বিশ্ব ইতিহাসে আজও শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে বিবেচিত।

 

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

 

৭ই মার্চের ভাষণকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ইতিহাসবিদদের অনেকেই বলেন শেখ মুজিবুর রহমান এই ভাষণটি জনগণের সামনে তুলে ধরার আগে পূর্ব প্রস্তুতি তেমন গ্রহণ করেননি। তাঁরা তাঁর মেধার প্রশংসা হিসেবেই কথাটা বলেন। বঙ্গবন্ধু লিখিত বক্তব্য দেননি ।

৭ই মার্চের ভাষণ এর সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে সরাসরি এক একটি করে মোট ১০১টি বাক্যের মধ্যে তিনি ভাষণটি শেষ করেন। তাঁর বক্তৃতার প্রতিটি বাক্যই অত্যস্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভাষণটি ছিল পূর্ব বাংলার জনমানুষের বঞ্চনা, নির্যাতন, জেল-জুলুম ও দুঃখের ২৩ বছরের সালতামামি একইসঙ্গে ছিল শোষণ ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণের রুখে দাঁড়ানো, প্রতিবাদের ঝড় তোলা এবং দাবি আদায়ের দুর্বিনীত সংগ্রামের আলেখ্য।

প্রত্যেক মানুষই যদি নিজের অবস্থানকে এক একটি দুর্গ ভাবে তাহলে মূল লক্ষ্য ‘স্বাধীনতা’ ছিনিয়ে আনা কঠিন হলেও অসম্ভব নয় ।

২৩ বছর ধরে দেশের প্রতিটি মানুষকে তিনি জেনেছেন, চিনেছেন। তাদের নাগরিক ও নৈতিক অধিকার এবং সংশয়মুক্ত জীবন ধারণের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সাহসী ও উপযুক্ত হয়ে দিয়েছেন। এ কারণে প্রতিটি মানুষ নিজেকে তৈরি করেছেন বিপ্লবী হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, আদর্শ ও নীতির প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ছিল শতভাগ ।

 

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

 

শিরোনামে ধৃত একটি বাক্যের যে শক্তিশালী আবেদন তা আমরা দেখি ২৬শে মার্চ থেকে পরবর্তী নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রধান প্রেরণা এবং যথাযথ পরিকল্পনা হিসেবে। যত দ্রুত সম্ভব অস্ত্র চালনা শিখতে হবে, অস্ত্র সংগ্রহ করতে হবে। নির্দিষ্ট পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে এখন সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণ করে পরাভূত করতে হবে ।

পরবর্তীকালে নয় মাস ধরে বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে যুদ্ধ করেছিল, তার প্রেরণা ও পদ্ধতি বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের মধ্যে নিহিত ছিল । তিনি জানতেন, বাংলার মানুষ তাঁর কথা বুঝবে, তাঁর আবেদনে দ্বিধাহীন চিত্তে স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়বে এবং মৃত্যুকে তাঁরা জয় করবে। জনগণ তাই করে দেখিয়েছে ।

অন্যদিকে পাকিস্তানি শাসকরা এই ভাষণের অন্তর্নিহিত বিষয়টি বুঝতে পেরেছিল কি পারেনি, তার চেয়ে বড়ো কথা, তৎকালীন সামরিক সরকার ভাষণ শেষে বেশ খুশি ও খানিকটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছিল। তারা ভেবেছিল, শেখ মুজিব ভয় পেয়েছে । যাক্ সে যে সরাসরি সেদিন পূর্ব বাংলার ‘স্বাধীনতা’ ঘোষণা দেয়নি সেটাই ছিল তাদের স্বস্তির কারণ।

রমনার মাঠে লাখো মানুষকে হত্যা করে মানব ইতিহাসে কলঙ্কময় নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিতে হলো না তাদের। তবে নিষ্ঠুরতার কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ড ২৫শে মার্চ থেকে শুরু করে পরবর্তী নয় মাসে তারা ঠিকই চালু রেখেছিল।

 

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

 

অনেকেই এমনকি জনতার বিশাল অংশও চেয়েছিল ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ‘বাংলাদেশ’ নামক স্বাধীন দেশের ঘোষণা দিয়ে দেবেন। বঙ্গবন্ধু ভাষণের প্রতিটি বাক্য এমনভাবে উচ্চারণ করেছিলেন যে, সেখানে ছিল তাঁর জীবনের দীর্ঘ সংগ্রামের অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক মেধা ও তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার কৌশল । ভাষণের মধ্যেই ছিল দেশকে শত্রুমুক্ত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার প্রধান কৌশল বা যুদ্ধের কথা।

বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে বলেন –  ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’

ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল আহ্বানের তাৎপর্য হলো- বাংলার প্রতিটি ঘর চাষীর ঘর, জেলের ঘর, জোলার ঘর, শিক্ষকের ঘর, চিকিৎসকের ঘর, চাকুরিজীবীর ঘর, শ্রমিকের ঘর, পুলিশের ঘর, নিরাপত্তাকর্মীদের ঘর, আইনজীবীদের ঘর এবং রাজনৈতিক নেতাদের ঘর; প্রত্যেক মানুষই যদি নিজের অবস্থানকে এক একটি দুর্গ ভাবে, তাহলে মূল লক্ষ্য ‘স্বাধীনতা’ ছিনিয়ে আনা কঠিন হলেও অসম্ভব নয় এই বিষয়টি বঙ্গবন্ধু ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।

তাই উপরিউক্ত বাক্যটির সঙ্গে সংযোগ করেছিলেন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ বাক্য- ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ এই ‘যা কিছু’ হলো বাঙালির প্রধান শক্তি। দা, কুড়াল, কাস্তে, লাঠি, ঝাড়ু এসব তখন মেশিনগানের শক্তি পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর বাক্য প্রয়োগের তাৎপর্য বাংলার মানুষের মনে যে মানসিক সাহস সঞ্চার করে সেটাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রধান শক্তি। চাষাবাদ ও গৃহস্থালির হাতিয়ারগুলোকেই তারা মনে করে এক একটি রাইফেল, এক একটি স্টেনগান, মেশিনগান ইত্যাদি।

 

Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
Bangabandhu 7th March Speech, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

 

তাই তারা দলে দলে দ্রুত সমরাস্ত্র চালনা শিখে নিয়ে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করে না। মিত্রশক্তি ভারতের সেনাবাহিনীও সাধারণ মানুষের এই শক্তি ও সাহস দেখে স্তম্ভিত হয়। অন্যান্য বিদেশি শক্তিও উপলব্ধি করে বাঙালি জাতিকে শেখ মুজিব যেভাবে জাগিয়ে তুলে মানসিক শক্তিতে বলীয়ান করেছেন, পাকিস্তানি সামরিক শক্তি কেন, অন্য কোনো শক্তিও বাঙালির এই মুক্তির সংগ্রামকে থামাতে পারবে না । বাংলার মানুষ তাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবেই

বাংলার মানুষ অপশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে জয়লাভ করেছে। আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বাঙালি অর্জন করে নিয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ’।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর এই ভাষণের শেষ পর্যায়ে এসে স্বাধীনতা অর্জনের কথা দুঃসাহসিক উচ্চারণে মানুষের মনে গেঁথে দিয়েছিলেন; বলেছিলেন প্রত্যেক গ্রামে, মহল্লায়, সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলতে এবং যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে ব্যক্ত করেছিলেন এ দেশের মানুষকে মুক্ত করার দৃঢ় অঙ্গীকার। বাংলার মানুষ এই দৃঢ়তা নিয়েই যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছেন

[ ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ]]

লেখক: হাশেম খান
চিত্রশিল্পী ও সাবেক অধ্যাপক, চারুকলা অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] হাশেম খান
‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো’ [ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ] হাশেম খান

 

আরও পড়তে পারেন :

Leave a Comment